অধিকাংশ ভাষায় অন্তত দুটি রীতি থাকে: ১. কথ্য ভাষা রীতি ও ২. লেখ্য ভাষা রীতি। বাংলা ভাষায় এসব রীতির একাধিক বিভাজন রয়েছে। যেমন কথ্য ভাষা রীতির মধ্যে রয়েছে আদর্শ কথ্য রীতি ও আঞ্চলিক কথ্য রীতি। আবার লেখ্য ভাষা রীতির মধ্যে রয়েছে প্রমিত রীতি, সাধু রীতি ও কাব্য রীতি। একে একে এসব রীতি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
১. কথ্য ভাষা রীতি
কথ্য ভাষা রীতি ভাষার মূল রূপ। কথ্য ভাষা রীতির উপরে ভিত্তি করে লেখ্য ভাষা রীতির রূপ তৈরি হয়। স্থান ও কালভেদে ভাষার যে পরিবর্তন ঘটে তা মূলত কথ্য ভাষা রীতির পরিবর্তন। তাই কথ্য ভাষা রীতির পরিবর্তনের ফলে নতুন নতুন ভাষা ও উপভাষার জন্ম হয়।
আঞ্চলিক কথ্য রীতি
কথ্য রীতির আঞ্চলিক ভেদ সহজে বোঝা যায়। এই আঞ্চলিক ভেদ সাধারণত অঞ্চলের নামে পরিচিতি পায় ৷ যেমন নোয়াখালীর ভাষা, চাঁপাই নবাবগঞ্জের ভাষা, কিংবা সুন্দরবন অঞ্চলের ভাষা। ভাষার এই আঞ্চলিকতা উপভাষা নামে আখ্যায়িত হয়ে থাকে। বাঙ্গালি (বাংলাদেশের মধ্য ও দক্ষিণ অঞ্চল), পূর্বি (বাংলাদেশের পূর্ব অঞ্চল, ত্রিপুরা এবং আসামের বরাক অঞ্চল), বরেন্দ্রি (বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল), কামরূপি (বিহারের পূর্ব অঞ্চল, পশ্চিমবঙ্গের উত্তর অঞ্চল এবং বাংলাদেশের রংপুর অঞ্চল), রাঢ়ি (পশ্চিমবঙ্গ), ঝাড়খণ্ডি (পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম অঞ্চল ও ঝাড়খণ্ডের পূর্ব অঞ্চল) প্রভৃতি কয়েকটি উপভাষার নাম ।
আদর্শ কথ্য রীতি
আদর্শ কথ্য রীতি হলো বাঙালি জনগোষ্ঠীর সর্বজনীন কথ্য ভাষা। বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় বেতার-টেলিভিশনে প্রচারিত আনুষ্ঠানিক বক্তব্যে, সংবাদ উপস্থাপনায়, সভা-সেমিনারের আলোচনায় ও কবিতা আবৃত্তিতে এই রীতির প্রয়োগ দেখা যায়। এই রীতিই বাংলা প্রমিত লেখ্য রীতির ভিত্তি। তবে বক্তার সামাজিক অবস্থান, জীবিকা, শিক্ষা ও সংস্কৃতি ভেদে আদর্শ কথ্য রীতিতে কমবেশি তফাত থাকে ।
২. লেখ্য ভাষা রীতি
লিখিত বাংলা ভাষার আদি নিদর্শনের নাম ‘চর্যাপদ’। প্রায় এক হাজার বছর আগে লেখ্য বাংলা ভাষার কাব্য রীতিতে এটি রচিত। ব্যবহারিক প্রয়োজনে ক্রমে লেখ্য গদ্য রীতির জন্ম হয়। উনিশ শতকের সূচনায় এই গদ্য রীতি সাধু রীতির জন্ম দেয়। বিশ শতকের সূচনায় সাধু রীতির পাশাপাশি চলিত রীতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। একুশ শতকের সূচনায় চলিত রীতির একটি আদর্শ রূপ প্রমিত রীতি হিসেবে গৃহীত হয়েছে। এই প্রমিত রীতিই লেখ্য বাংলা ভাষার সর্বজনগ্রাহ্য লিখিত রূপ ৷
কাব্য রীতি
বাংলা কাব্য রীতি দুই ভাগে বিভক্ত: পদ্য কাব্য রীতি ও গদ্য কাব্য রীতি। পদ্য কাব্য রীতিতে ছন্দ এবং মিল থাকে। ফলে তা ভাষার সাধারণ বাক্যগঠন থেকে আলাদা হয়। পদ্য কাব্য রীতি বাংলা ভাষার সবচেয়ে পুরনো রীতি। বাংলা সাহিত্যের বহু অমর কাব্য এই রীতিতে রচিত। পদ্য কাব্য রীতির পাশাপাশি বাংলা ভাষায় গদ্য কাব্য রীতিও রয়েছে। গঠন বিবেচনায় গদ্য কাব্য রীতির বাক্যও সাধারণ বাক্যের চেয়ে আলাদা হয়ে থাকে ।
সাধু রীতি
দাপ্তরিক কাজ, সাহিত্য রচনা, যোগাযোগ ও জ্ঞানচর্চার প্রয়োজনে লেখ্য বাংলা ভাষায় সাধু রীতির জন্ম হয়। উনিশ শতকের শুরুর দিকে সাধু রীতির বিকাশ ঘটে। প্রায় দুই শতাব্দী ধরে এই রীতি বাংলা লেখ্য ভাষার আদর্শ রীতি হিসেবে চালু থাকে। সাধু রীতির সাধারণ বৈশিষ্ট্য:
ক. সাধু রীতিতে ক্রিয়ারূপ দীর্ঘতর, যেমন ‘করা’ ক্রিয়ার রূপ: করিতেছে, করিয়াছে, করিল, করিলে, করিলাম, করিত, করিতেছিল, করিয়াছিল, করিব, করিবে, করিতে, করিয়া, করিলে, করিবার।
খ. সাধু রীতির বহু সর্বনামে ‘হ’-বৰ্ণ যুক্ত থাকে, যেমন – তাহারা, ইহাদের, যাহা, তাহা, উহা, কেহ ইত্যাদি ।
সাহিত্যে সাধু রীতির উদাহরণ:
মহাসমুদ্রের শত বৎসরের কল্লোল কেহ যদি এমন করিয়া বাঁধিয়া রাখিতে পারিত যে, সে ঘুমাইয়া পড়া শিশুটির মতো চুপ করিয়া থাকিত, তবে সেই নীরব মহাশব্দের সহিত এই লাইব্রেরির তুলনা হইত। এখানে ভাষা চুপ করিয়া আছে, প্রবাহ স্থির হইয়া আছে, মানবাত্মার অমর আলোক কালো অক্ষরের শৃঙ্খলে কাগজের কারাগারে বাঁধা পড়িয়া আছে। ইহারা সহসা যদি বিদ্রোহী হইয়া উঠে, নিস্তব্ধতা ভাঙিয়া ফেলে, অক্ষরের বেড়া দগ্ধ করিয়া একেবারে বাহির হইয়া আসে! হিমালয়ের মাথার উপরে কঠিন বরফের মধ্যে যেমন কত কত বন্যা বাঁধা আছে, তেমনি এই লাইব্রেরির মধ্যে মানবহৃদয়ের বন্যাকে বাঁধিয়া রাখিয়াছে! (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, উনিশ শতক)
দাপ্তরিক কাজে সাধু রীতির উদাহরণ:
আমরা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করিতেছি যে, আমরা যাহাতে স্বাধীন সত্তায় সমৃদ্ধি লাভ করিতে পারি এবং মানবজাতির প্রগতিশীল আশা-আকাঙ্ক্ষার সহিত সঙ্গতি রক্ষা করিয়া আন্তর্জাতিক শান্তি ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে পূর্ণ ভূমিকা পালন করিতে পারি, সেইজন্য বাংলাদেশের জনগণের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তিস্বরূপ এই সংবিধানের প্রাধান্য অক্ষুণ্ণ রাখা এবং ইহার রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তাবিধান আমাদের পবিত্র কর্তব্য। (বাংলাদেশের সংবিধান, বিশ শতক)
প্রমিত রীতি
বিশ শতকের সূচনায় কলকাতার শিক্ষিত লোকের কথ্য ভাষাকে লেখ্য রীতির আদর্শ হিসেবে চালু করার চেষ্টা হয়। এটি তখন চলিত রীতি নামে পরিচিতি পায়। এই রীতিতে ক্রিয়া, সর্বনাম, অনুসর্গ প্রভৃতি শ্রেণির শব্দ হ্রস্ব হয় এবং তৎসম শব্দের ব্যবহার অপেক্ষাকৃত কমে। প্রথম দিকে চলিত রীতিতে শুধু সাহিত্য রচিত হতো; দাপ্তরিক কাজ ও বিদ্যাচর্চা ইত্যাদি হতো সাধু ভাষায়। বিশ শতকের মাঝামাঝি নাগাদ চলিত রীতি সাধু রীতির জায়গা দখল করে। ক্রমে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাধু রীতিকে সরিয়ে চলিত রীতি আদর্শ লেখ্য রীতিতে পরিণত হয়। একুশ শতকের সূচনা নাগাদ এই চলিত রীতিরই নতুন নাম হয় ‘প্রমিত রীতি’। এটি ‘মান রীতি নামেও পরিচিত। বর্তমানে বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় যাবতীয় দাপ্তরিক কাজ, বিদ্যাচর্চা, সাংবাদিকতা ও যোগাযোগের ভাষা হিসেবে প্রমিত রীতি লেখ্য বাংলা ভাষার প্রধান রীতিতে পরিণত হয়েছে।
প্রমিত রীতির সাধারণ বৈশিষ্ট্য :
(ক) প্রমিত রীতিতে ক্রিয়া, সর্বনাম ও অনুসর্গ হ্রস্বতর।
ক্রিয়ার ক্ষেত্রে যেমন: ‘করাত ক্রিয়ার রূপ: করছে, করেছে, করল, করলে, করলাম, করত,
করছিল, করেছিল, করব, করবে, করতে, করে, করলে, করার।
সর্বনামের ক্ষেত্রে যেমন – তারা, এদের, যা, তা, ও, কেউ ইত্যাদি ।
অনুসর্গের ক্ষেত্রে যেমন – থেকে, হতে, সঙ্গে ইত্যাদি।
(খ) প্রমিত রীতিতে শব্দ ব্যবহার আলোচ্য বিষয়ের উপরে নির্ভরশীল। প্রয়োজন অনুযায়ী সব ধরনের
শব্দ ব্যবহার করা যায়। যেমন তৎসম ‘বৎসর’-ও লেখা যায় আবার তদ্ভব ‘বছর’-ও লেখা যায়। একইভাবে ‘চন্দ্ৰ’-ও লেখা যায়, ‘চাঁদ’-ও লেখা যায়।
(গ) প্রমিত রীতিতে কথ্য রীতির বহু শব্দ বর্জনীয়, যেমন: ‘ধুলো, তুলো, মুলো, পুজো, সবচে’ ইত্যাদি না লিখে ‘ধুলা, তুলা, মুলা, পূজা, সবচেয়ে’ ইত্যাদি লিখতে হয়।
পূর্বে উল্লিখিত সাধু রীতির সাহিত্যের উদাহরণ প্রমিত রীতিতে নিম্নরূপ হবে:
মহাসমুদ্রের শত বৎসরের কল্লোল কেউ যদি এমন করে বেঁধে রাখতে পারত যে, সে ঘুমিয়ে পড়া শিশুটির মতো চুপ করে থাকত, তবে সেই নীরব মহাশব্দের সঙ্গে লাইব্রেরির তুলনা হতো। এখানে ভাষা চুপ করে আছে, প্রবাহ স্থির হয়ে আছে, মানবাত্মার অমর আলোক কালো অক্ষরের শৃঙ্খলে কাগজের কারাগারে বাঁধা পড়ে আছে। এরা সহসা যদি বিদ্রোহী হয়ে ওঠে, নিস্তব্ধতা ভেঙে ফেলে, অক্ষরের বেড়া দগ্ধ করে একেবারে বের হয়ে আসে। হিমালয়ের মাথার উপরে কঠিন বরফের মধ্যে যেমন কত কত বন্যা বাঁধা আছে, তেমনি এই লাইব্রেরির মধ্যে মানবহৃদয়ের বন্যাকে বেঁধে রেখেছে।
পূর্বে উল্লিখিত সাধু রীতির দাপ্তরিক উদাহরণ প্রমিত রীতিতে নিম্নরূপ হবে:
আমরা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করছি যে, আমরা যাতে স্বাধীন সত্তায় সমৃদ্ধি লাভ করতে পারি এবং মানবজাতির প্রগতিশীল আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে আন্তর্জাতিক শান্তি ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে পূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারি, সেজন্য বাংলাদেশের জনগণের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তিস্বরূপ এই সংবিধানের প্রাধান্য অক্ষুণ্ণ রাখা এবং এর রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তাবিধান আমাদের পবিত্র কর্তব্য। প্রতিটি বাঙালি শিশুর মাতৃভাষা বা প্রথম ভাষা হলো তার আঞ্চলিক ভাষা। আদর্শ কথ্য বা লেখ্য প্রমিত তার কাছে দ্বিতীয় ভাষা। বাংলাদেশের শিক্ষা কার্যক্রম যেহেতু প্রমিত রীতি অনুসরণ করে, তাই পাঠ্যপুস্তকই হলো শিশুর প্রমিত রীতি শেখার প্রধান উপায়।