সরকারিভাবে খুব কম খরচে দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রতিবছর চাকরি করতে যান শত শত বাংলাদেশি। বোয়েসেলের মাধ্যমে এই যাবতীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়। নিজে নিজেই আপনি সবগুলো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারেন। দক্ষিণ কোরিয়ায় কাজের উদ্দেশ্যে যেতে হলে কোরিয়ান ভাষায় দক্ষতা অর্জন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ থেকে সরকারিভাবে দক্ষিণ কোরিয়ায় যেতে চাইলে নিম্নলিখিত ধাপগুলো অনুসরণ করতে হবে। বর্তমানে সরকারি ব্যবস্থাপনায় বোয়েসলের মাধ্যমে দুইভাবে দক্ষিণ কোরিয়ায় যাওয়া যায়।
ভাষা শিখে লটারি পেয়ে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে, ভাষা পারদর্শী হিসাবে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ৷ প্রথমেই বলে নেই এই লাইনে প্রচুর ধৈর্যের দরকার, আপনার যদি ধৈর্য না থাকে তবে এই লাইনে আসবেন না ৷ কেননা, EPS (Employment Permit System) একটি লম্বা সময়ের প্রক্রিয়া। এর অনেকগুলো ধাপ রয়েছে। আর প্রতিটি ধাপেই রয়েছে অনিশ্চয়তা। নিম্নে সংক্ষিপ্ত আকারে যথাসম্ভব প্রতিটি ধাপ বর্ণনা করার চেষ্টা করছি।
প্রথম ধাপঃ EPS ভিসার প্রথম ও প্রধান শর্ত হলো- কোরিয়ান ভাষার ওপর দক্ষতা থাকা। এই ভাষা যেকোনো ভাবেই শিখতে পারেন। নিজে নিজে অথবা সরকার স্বীকৃত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অথবা বিভিন্ন কোচিং সেন্টারে ৷ ভাষার উপর পরীক্ষা দুইভাবে হয়- ১. রিডিং ২. লিসেনিং।
২য় ধাপঃ ভাষা শিক্ষার পর আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে সার্কুলারের। সার্কুলার BOESL (Bangladesh Overseas Employment & Services Ltd) এর মাধ্যমে বিভিন্ন পত্রিকাতে ও বোয়েসেল ওয়েবসাইটে পাবলিশ হবে সঙ্গে BOESLএর ফেসবুক পেইজে। সার্কুলার হলে আপনাকে প্রাথমিকভাবে অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। অনলাইনে রেজিস্ট্রাশন করতে হলে কি কি যোগ্যতা থাকতে হবে তা স্পষ্ট করে সার্কুলারে লেখা থাকবে।
রেজিস্ট্রেশন কোথায় করবেন: কম্পিউটার হলে নিজেই করা যায়। আবার এন্ড্রয়েড ফোন দিয়েও হয়। না পারলে যেকোনো কম্পিউটারের দোকানে গিয়ে রেজিস্ট্রেশন সম্পূর্ন করতে হবে। রেজিস্ট্রেশন এর জন্যে বোয়েসেল নির্ধারিত ফি বিকাশের মাধ্যমে জমা করে ট্রান্সফার আইডি সংরক্ষণ করতে হয়, রেজিস্ট্রেশন সম্পূর্ণ হলে আপনাকে কনফার্মেশন একটা প্রিন্ট কপি দেয়া হবে। সঙ্গে একটা সিরিয়াল নাম্বার থাকবে, যা আপনাকে সংরক্ষণ করতে হবে।
৩য় ধাপঃ যদি চাহিদার চেয়ে অনেক বেশি রেজিস্ট্রেশন হয়, তখন সব রেজিস্ট্রেশন থেকে কোটা সমপরিমান লোক লটারির মাধ্যমে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়ে থাকে। এই লটারিতে অনেকে ভাষা না জানা ব্যাক্তিরা চান্স পেয়ে যায় আবার ঠিক তেমনি ভাষার ওপর ভালোভাবে পড়াশুনা করা দক্ষ ব্যক্তিরাও বাদ পড়ে যায়। এটি সম্পূর্ণ কম্পিউটারাইজড সিলেকশন, যা HRD কোরিয়া করে থাকে, সুতরাং আপনার বা অন্য কারো ক্ষমতা থাকে না।
৪র্থ ধাপঃ আপনি লটারির মাধ্যমে সিলেকশনের পর সব ধরনের কাগজপত্র একত্রিত করে আপনাকে স্বশরীরে বোয়েসেল গিয়ে মূল রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। এই রেজিস্ট্রেশন প্রাপ্ত সিরিয়াল নম্বর আপনাকে সবসময় সংরক্ষণ করতে হবে। অনলাইন থেকে এডমিট কার্ড সংগ্রহ করতে হবে। সবকিছু ঠিকঠাক করে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে।
৫ম ধাপঃ UBT (Ubiquitous Based Test) পরীক্ষা হবে। কম্পিউটারের সামনে বসে রিডিং ও লিসেনিং একসাথে পরীক্ষা দিতে হবে। পরিক্ষার শেষে নিজে যে কম্পিউটারে বসে পরিক্ষা দিলেন সেই কম্পিউটারেই নিজের প্রাপ্ত নম্বর জানা যাবে। [একদম পরীক্ষা শেষে] তাই একটু বসে থাকতে হবে। পরীক্ষা অপেক্ষাকৃত ভালো হলে পরবর্তী ধাপে এগোতে হবে।
৬ষ্ঠ ধাপঃ ভাষা পরীক্ষার পর স্কিল টেস্ট নামে আরো একটি পরীক্ষা হবে। স্কিল টেস্ট কেমন ও কীভাবে হবে তা অভিজ্ঞ ইন্সট্রাক্টরের কাছ থেকে জেনে নিতে হবে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিয়ম পরিবর্তন হয়েছে, হয়তো আরোহবে।
৭ম ধাপঃ সব পরীক্ষায় পাশ করার পর PRS (Point Recruiting System) এর মাধ্যমে কোটা সমপরিমান লোক রেখে বাকিদের ডিলেট করে দেওয়া হবে। অর্থাৎ যারা পয়েন্টে এগিয়ে থাকবে মানে যারা বেশি নাম্বার পাবে তারা কোটাতে চান্স পাবে এবং বাকিরা বাদ পড়ে যাবে। সুতরাং দুইশোতে ১৫০ পেয়েও বাদ পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
৮ম ধাপঃ আপনি টিকে যাবার পর আপনাকে নোটিশের মাধ্যমে জানানো হবে। তারপর আপনাকে আপনার পাসপোর্টে উল্লেখিত স্থায়ী ঠিকানায় সিভিল সার্জন কর্তৃক মেডিক্যাল চেকআপ করে মেডিক্যাল সার্টিফিকেট সংগ্রহ করতে হবে এবং জব ফর্ম পূরণ করে বোয়েসেল গিয়ে জমা দিতে হবে। সাথে কি কি নিয়ে যেতে হবে বোয়েসেল সব নোটিশে বলে দিবে ৷
৯ম ধাপঃ সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আপনাকে রোস্টারভুক্ত করা হবে এবং আপনি www.eps.go.kr এ ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখতে পাবেন। এখানে একটা আইডি খোলার পর আপনার সব ইনফরমেশন আপনার ওই আইডিতে পাওয়া যাবে। আপনার কাজ হবে কিছুদিন পর পর HRD কোরিয়া কর্তৃক ভিসা ইস্যুর তারিখে আইডি তে ঢুকে খোজ খবর নেওয়া। এরপর কোরিয়ান কোন কম্পানির মালিকের উপর নির্ভর করবে আপনার ভিসা হবে কি হবে না, আপনার ছবি, বয়স, বায়োডাটা দেখে মালিক পছন্দ করার পর আপনার ভিসা ইস্যু হবে এবং HRD Korea এর মাধ্যমে BOESL কে জানিয়ে দেবে। বোয়েসেল কর্তৃপক্ষ মোবাইল, ম্যসেজ বা ইন্টারনেটে নোটিশের মাধ্যমে আপনাকে জানাবে ৷
১০ম ধাপঃ আপনাকে জানানোর পরে অর্থাৎ CCVI কনফার্ম হওয়ার পর আপনাকে দুই সপ্তাহব্যাপী একটা ট্রেনিং দেওয়া হবে। এর মধ্যে ফ্লাইট ডেট কনফার্ম করতে হবে। পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট করতে হবে। ফিঙ্গার প্রিন্ট করতে হবে এবং কোরিয়ান মালিক প্রদত্ত কন্টাক্ট পেপার সাইন করতে হবে।
১১তম ধাপঃ কোরিয়া আসার পূর্বে বোয়েসেল অফিসে একটা ব্রিফিং দেওয়া হবে ৷ ৩০০ টাকার স্ট্যাম্পে চুক্তিনামা সাক্ষর করতে হবে। BOESL নির্ধারিত জামানত এর টাকা পরিশোধ করতে হবে এবং নির্দিষ্ট দিনে কোরিয়া গমন করতে হবে।
১২তম ধাপঃ কোরিয়া আসার পর আপনাকে KBiz Center এ আরেক দফা ট্রেনিং করতে হবে। ট্রেনিং এর পৃর্বে আপনার মেডিকেল চেক-আপ হবে, এতে যদি আপনি আনফিট হন, তাহলে ভাগ্য খারাপ হলে দেশে ফিরে যেতে হবে। বিশেষ করে:- মাদকাসক্ত (যারা দেশে বিভিন্ন প্রকার নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করেন।) এইচআইভি, হেপাটাইটিস প্রব্লেম, করোনাসহ বিভিন্ন প্রকার ফ্লু বা ভাইরাস। সব ঠিক থাকলে এরপর মালিক এসে আপনাকে নিয়ে যাবে। ব্যাস আপনি এখন EPS এর গর্বিত একজন সদস্য।
দক্ষিণ কোরিয়ায় যেসব খাতে কাজের সুযোগ
এমপ্লয়মেন্ট পারমিট সিস্টেমের (ইপিএস) আওতায় ২০০৮ সাল থেকে বাংলাদেশ থেকে সরকারিভাবে দক্ষিণ কোরিয়ায় কর্মী পাঠানো শুরু হয়েছে। সাধারণত অটোমোবাইল, টেক্সটাইল, কৃষিজাত খাদ্যসহ বিভিন্ন খাতে সাধারণ ও ‘কমিটেড/স্পেশাল সিবিটি (কম্পিউটার বেজড টেস্ট)’—এই দুই ধরনের কর্মী নেওয়া হয় দেশটিতে।
কোরিয়া যাওয়ার শিক্ষাগত যোগ্যতা
শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকতে হবে ন্যূনতম এসএসসি বা সমমান অথবা ভোকেশনাল বা ডিপ্লোমা ডিগ্রি। বয়স ১৮ থেকে ৩৯ বছর। কোরিয়ান ভাষা বোঝা, লেখা ও বলায় পারদর্শী। কালার ব্লাইন্ড বা রং বোঝার দুর্বলতা নেই। যারা এর আগে দক্ষিণ কোরিয়ায় ই৯ বা ই১০ ভিসায় গিয়ে সব মিলে পাঁচ বছরের বেশি থাকেনি বা অবৈধভাবে অবস্থান করেনি। বৈধ ও হালনাগাদ মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট আছে যাদের। ফৌজদারি অপরাধে কখনো জেল-জরিমানা বা শাস্তি হয়নি, এমন প্রার্থী।
প্রয়োজনীয় আরো কিছু তথ্যঃ পাসপোর্ট, সার্টিফিকেট (এসএসসি), ভোটার আইডি এবং অন্যান্য সকল কাজগপত্রে আপনার নাম, ঠিকানা, বাবার নাম ও জন্ম তারিখ হুবহু থাকতে হবে। কোন প্রকার সমস্যা থাকলে আগেই ঠিক করে নেবেন। এই EPS এর প্রক্রিয়া চলাকালীন সময়ে আপনার পড়াশুনা, ব্যাবসা বাণিজ্য ও চাকুরী নিয়মিত করতে থাকবেন। কারণ প্রতিটি ধাপেই রয়েছে অনিশ্চয়তা। যেকোনও কারণে, অল্প কারণে কিংবা বিনা কারণেই আপনি বাদ পড়তে পারেন। EPS এর প্রক্রিয়ার কোন ধাপেই নগদ অর্থের প্রয়োজন হয় না। ভিসা ইস্যুর পর প্লেনের টিকিট নিজে কাটতে হয় এবং সমস্ত খরচ পে-অর্ডারের মাধ্যমে জমা দিতে হয়। EPS এর নিয়মাবলী পরিবর্তনযোগ্য। সুতরাং সময়ের সাথে সাথে সবসময় আপডেট বা পরিবর্তন হতে পারে।
উল্লেখ্য, কোরিয়ান ভাষা শেখা ও দক্ষতা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া দক্ষিণ কোরিয়ায় কাজের জন্য যাওয়ার প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সঠিক নিয়ম ও প্রক্রিয়া অনুসরণ করে আবেদন করলে সফলতার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। আরো বিস্তারিত তথ্যের জন্য বোয়েসেলের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট পরিদর্শন করতে পারেন: BOESL.PORTAL.GOV.BD।