এইচএসসি বা উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষেই শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষার্থে অংশগ্রহণ করতে হয় ভর্তি যুদ্ধে। এই যুদ্ধে বিজ্ঞান বিভাগে প্রতিদ্বন্দ্বিতাটি হয় বেশ প্রতিযোগিতাপূর্ণই। তাই যোগ্যতা প্রমাণ করতে ঘাম ঝড়াতে হয়।
প্রথমেই আপনার লক্ষ্য ঠিক করতে হবে, আপনি কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দেবেন। সাধারণত, এই কাজটি এইচএসসির পরপরই এবং রেজাল্ট বেরোবার আগেই করে নিতে হয়। কারণ, রেজাল্ট বেরোনো পর্যন্ত দেরি করলে প্রস্তুতির পর্যাপ্ত সময় পাওয়া যায় না।
এক্ষেত্রে বিভিন্ন সাবজেক্টে কতটা দখল আছে, সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয়া যুক্তিযুক্ত। যেমন: গণিত, পদার্থবিজ্ঞান এসবে দক্ষতা থাকলে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল অনুষদকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
আর জীববিজ্ঞান, রসায়ন এসবে দক্ষতা থাকলে মেডিকেল কলেজ বা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় অথবা সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কৃষি, মৎস্য এবং জীববিজ্ঞান সম্পর্কিত অনুষদগুলোকে টার্গেট করতে পারেন।
আর যদি কোনো কারণে বাংলা, ইংরেজি, সাধারণ জ্ঞান এসবে আগ্রহ, দক্ষতা বেশি থাকে, তবে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডি ইউনিটগুলোকে সামনে রেখে আগাতে পারেন। এতে বিভাগ পরিবর্তন করে অন্যান্য সেক্টরে পড়তে পারবেন।
এরপর টার্গেট করতে হবে প্রশ্নপদ্ধতির। কারণ, দুঃখজনক হলেও বাস্তবতা হলো একেক বিশ্ববিদ্যালয় একেক ধাঁচে পরীক্ষা নিয়ে থাকে। প্রশ্নের মানবণ্টন হয়ে থাকে একেকরকম। তাই সেদিকটা দেখে রাখাই নিরাপদ।
উদাহরণ দিতে গেলে বলা যায়, কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় শুধু বিজ্ঞান বিভাগের বিষয়গুলো (পদার্থ, রসায়ন, গণিত, জীববিজ্ঞান) থেকে প্রশ্ন আসে, আবার কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে এগুলোর সাথে বাংলা, ইংরেজি, আইসিটি ইত্যাদি থেকেও প্রশ্ন এসে থাকে। তাই এসব বিশ্লেষণ করে আগানোই ভালো। এক্ষেত্রে পুরাতন প্রশ্নব্যাংক এবং একেবারে নতুন বছরের ভর্তির সার্কুলার তথা বিজ্ঞপ্তি কাজে দেবে।
এর মোকাবিলা করার জন্যও এইচএসসির পর থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। কিছু ব্যাকাপ প্ল্যান নিয়ে রাখা অসময়ে কাজে দেয়।
যেমন: আপনি যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকেন, তবে এর সাথে বাংলা, সাধারণ জ্ঞানে টুকিটাকি জ্ঞান থাকলে জাহাঙ্গীরনগরের প্রস্তুতি হয়ে যাবে। আবার ঢাবি ডি ইউনিটের প্রস্তুতি যদি কেউ নিতে থাকে, সাথে সে যদি জীববিজ্ঞানের হালকা প্রস্তুতি নেয়, তাহলে জাহাঙ্গীরনগরের জীব বিষয়ক ইউনিটগুলোতে পরীক্ষা দিতে পারবেন। এভাবেই ম্যানেজ করে নেয়া সম্ভব, একটু আগে থেকে গুছিয়ে প্রস্তুতি নিলে।
যখন আপনার ভার্সিটি বেছে নেয়া হয়ে গেল, এরপর পরই আসে অনুষদ বা বিভাগ কেন্দ্রিক প্রস্তুতি। এর কারণ হচ্ছে, অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই দেখা যায় এক বিজ্ঞান বিভাগের জন্যই বেশ কয়েকটা ইউনিট খুলে বসে। এর জন্য শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি বাড়ল না কমলো সেদিকে নজর না দিয়েই।
তো যাই হোক, বিশেষায়িত অনুষদগুলোর জন্য প্রস্তুতিও বিশেষই হওয়া চাই, নচেৎ পাল্লা দিয়ে টিকে থাকা যায় না। এখানে সবথেকে কাজে আসবে যে জিনিস, সেটা হচ্ছে পূর্ববর্তী বছরের প্রশ্ন সমাধান। এতে একটা পূর্ণাঙ্গ আইডিয়া হয়ে যাবে। আপনি যদি বাজার থেকে যেকোনো ভালো ব্র্যান্ডের প্রশ্নব্যাংক কিনে নিয়ে বিগত কয়েক বছরের প্রশ্ন সলভ করে ফেলেন, এতেই বুঝে যাবে প্রশ্নপ্যাটার্ন কেমন হয়।
সবশেষে যখন আপনার ভার্সিটি, অনুষদ এইসব ভাবা শেষ, এখন আসবে আসল জায়গায়। বিষয় ভিত্তিক প্রস্তুতিতে জোর দিতে হবে। মূল বই, মূল বই এবং মূল বই!!! যে বিষয়েই বলা হোক, প্রস্তুতির শুরুটা হবে এইচএসসির টেক্সটবইটা দিয়েই, আর সিংহভাগ কাভারও হয়ে যাবে এই থেকেই।
মেইন বই পড়ার পর সবথেকে কাজে আসবে বলতে গেলে প্রশ্নব্যাংক, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ভিত্তিক, সাল ভিত্তিক। তারপর আসবে অন্যান্য যদি সহায়ক বই থাকে যেমন, মডেল টেস্ট বা কনসেপ্ট বুক, সাপ্লিমেন্ট বুক, কন্সাইজ বুক ইত্যাদি। ভালো করে মনে রাখতে হবে, এই বইগুলো কোনোমতেই মূল বইয়ের পরিপূরক হতে পারে না। মূল বইয়ের পড়ার পর এসব কাজে আসবে, তার আগে নয়।
সত্যি বলতে ভর্তি পরীক্ষায় বাদ দেয়া বা দাগিয়ে পড়া বলতে কিছু নেই। একদম প্রায় সবই পড়তে হয়। পদার্থবিজ্ঞানে প্রস্তুতির জন্য উচ্চমাধ্যমিক পাঠ্যবইয়ের প্রথম পত্র থেকে গতির সূত্র, মহাকর্ষ ও অভিকর্ষ, স্থিতিস্থাপকতা, তাপ, গতিবিদ্যা, ভেক্টর ও স্কেলার রাশি, বেগ, ত্বরণ, বল ও বলের প্রকারভেদ, মাত্রা ও বিভিন্ন পদ্ধতিতে একক ইত্যাদি পড়তে হবে।
পদার্থ দ্বিতীয় পত্র থেকে স্থিরবিদুৎ, বিদুৎপ্রবাহের তাপীয় ও রাসায়নিক ক্রিয়া, চৌম্বক পদার্থ, আলোর প্রতিফলন, প্রতিসরণ, ইলেক্ট্রন, প্রোটন, পরমাণুসহ ইলেক্ট্রনের প্রতিটি অধ্যায় থেকে গুরুত্বপূর্ণ সংজ্ঞা, সূত্রাবলি, ঘটনা ও কারণ, প্রভাব, পার্থক্য, গাণিতিক সমস্যার সমাধান জানতে হবে। পদার্থ বিষয়ে কিছু প্রশ্ন গাণিতিক হয়। সে কারণে গাণিতিক সমস্যার সমাধানগুলো ভালোভাবে করতে হবে। এর সঙ্গে গাণিতিক সমাধান দ্রুত করতে পারার বিষয়টিও আয়ত্ত করতে হবে। কারণ কত সুন্দর করে তুমি কোনো প্রশ্নের উত্তর করতে পারো তার থেকে ভর্তি পরীক্ষায় যেটি বেশি দেখা হয়, তা হচ্ছে কত কম সময়ে তোমরা এটা সলভ করতে পারো।
রসায়নের ক্ষেত্রেও কথা একই, বাদ না দেয়াই সেইফ। উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণীর রসায়ন মূল পাঠ্য বইয়ের মধ্যে থেকে পদার্থের বিভিন্ন অবস্থা, পর্যায় সারণী, রাসায়নিক গণনা, জারণ-বিজারণ, রাসায়নিক বন্ধন, রাসায়নিক বিক্রিয়া, প্রতীক, সংকেত, যোজনী, গাঠনিক সংকেত, আণবিক সংকেত, রাদারফোর্ড, বোরের পরমাণু মডেল বিষয়গুলো ভালোভাবে আয়ত্ত করতে হবে। মনে রাখবেন রসায়ন কিছুটা মুখস্ত নির্ভর, তাই কষ্ট হলেও মনে রাখবেন বিভিন্ন তথ্য উপাত্তগুলো।
একটি বিষয় সবসময়ই মনে রাখতে হবে, এইচএসসির সিলেবাস তো বটেই, ভর্তি পরীক্ষায় সফল হতে হলে বইয়ের সব অধ্যায়ই ভালোভাবে পড়তে হবে। ভর্তি পরীক্ষায় সফল হতে হলে বইয়ের কোনো অধ্যায়ই এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই।
উচ্চতর গণিতের জন্য প্রয়োজনীয় সূত্রগুলো একজায়গায় লিখে রাখবেন। পরীক্ষার আগে সেসব যাতে একবার চোখ বুলিয়ে গেলেই হয়, এমন একটা দখল পড়ার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। আর পরীক্ষার প্রস্তুতি পর্যায়ে প্রচুর অনুশীলন করতে হবে, অনুশীলন করতে করতে আয়ত্তে নিয়ে আসতে হবে।
পড়ার টেবিলের সামনে বা এমন জায়গায় রাখবে যেখান থেকে সহজেই দেখা যায়। আর ফটোগ্রাফিক মেমরি বাড়াতে হবে, মুখস্তবিদ্যা থেকে যতটা সম্ভব সরে আসার চেষ্টা করতে হবে। সরলরেখা, কণিক, বৃত্ত, ত্রিকোণমিতিক অনুপাত, বিপরীত ত্রিকোণমিতিক অনুপাত, দ্বিপদী, বহুপদী এই অধ্যায়গুলো মনোযোগ দিয়ে করতে হবে।
জীববিজ্ঞানের দুটি অধ্যায়। উদ্ভিদবিজ্ঞান ও প্রাণীবিজ্ঞান। উদ্ভিদবিজ্ঞান থেকে পাঠ্যবইয়ের সব অধ্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার, আবিষ্কারকের নাম, প্রয়োজনীয় সংজ্ঞা, উদাহরণ, পার্থক্য, উদ্ভিদের শ্রেণীবিন্যাস, সালোক সংশ্লেষণ, শ্বসন, প্রস্বেদন, টিস্যু, টিস্যুতন্ত্র বিষয়গুলো পড়তে হবে। কিছুই বাদ দেয়া যাবে না, এগুলোতে শুধু বেশি জোর দিতে বলা হচ্ছে। প্রাণীবিজ্ঞান অংশের ম্যালেরিয়ার জীবাণু, হাইড্রা, দেহপ্রাচীর, কলা, কোষ, প্রাণীর বৈজ্ঞানিক নাম, পরিপাকতন্ত্র, রক্ত ও রক্ত সংবহনতন্ত্র, রেচনতন্ত্র, পেশিতন্ত্র, প্রাণীর প্রজননতন্ত্র ইত্যাদি বিষয় পড়তে হবে। এক্ষেত্রে অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে, প্রতিটি বিষয়ের যতটা সম্ভব খুঁটিনাটি বিষয় যেন আপনার আয়ত্তে থাকে।